Tuesday, October 16, 2018

লালাখাল সিলেটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান (Lalakhal is the most attractive tourist spots in Sylhet)



সিলেট শহর থেকে প্রায় 35 কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলায় স্বচ্ছ নীল পানির একটি নদী যার নাম লালাখাল। এটি বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত একটি পর্যটন এলাকা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। প্রকৃতিকে একান্তে অনুভব করার জন্য স্থানটি বেশ উপযোগী। পাহাড়ে ঘন সবুজ বন, নদী, চা-বাগান ও নানা জাতের বৃক্ষের সমাহার লালাখালজুড়ে। পানি এবং প্রকৃতির সমন্বয় আপনাকে একটি অসাধারণ অনুভূতি দেবে। আপনি অপার শান্তির আমেজ অনুভব করবেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এখানে আপনি আদিবাসীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পাবেন। এলাকাটি পর্যটকদের জন্য একটি প্রিয়, পছন্দসই এবং প্রতীক্ষিত জায়গা। সড়কপথ, নৌপথ দুভাবেই যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও নৌ ভ্রমণটা বেশি উপভোগ্য বলে এটাকেই বেছে নেয় অধিকাংশ পর্যটক। নৌপথে যেতে যেতে যেদিকে চোখ যায়, মুগ্ধতায় নেমে আসে মগ্নতা! নিশ্চিতভাবে কিছুক্ষণের জন্য আপনি কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে চলছেন, এ খেয়াল হবেই না! ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই লালাখালের অবস্থান। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। লালাখাল ভ্রমণের জন্য শীতের প্রথম ভাগটাই উপযুক্ত সময়। চাইলে বৃষ্টির দিনে ভ্রমণ করা যেতে পারে। তবে শীতের সময়টা বেশ নিরাপদ।




লালাখালের সৌন্দর্যের বর্ণনাঃ



বলে নেওয়া ভালো, চাইলে সারা দিন লালাখালে কাটাতে পারেন, আবার দিনের শেষ ভাগটা কাটিয়ে আসতে পারেন। সারা দিনের জন্য গেলে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় ফিরলে দুই ধরনের আনন্দ পাওয়া যায়। লালাখালের চারপাশে সন্ধ্যার আগমুহূর্তটা আরো অবিস্মরণীয়। ওপরে আলোকিত আকাশ। ক্লান্ত সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে। চারপাশে গাছপালার মধ্যে পাখির কিচিরমিচির। এসব দেখলে মনে হয়, পাহাড় থেকে তিরতির সন্ধ্যা নেমে আসছে। ধীরে ধীরে গোধূলিকেও আঁধার ঢেকে দেয়। ক্রমে চারপাশে নেমে আসে আঁধার। সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে লালাখালের স্বচ্ছ নীল জলে। সঙ্গে জ্যোৎস্না রাতে নৌকায় লালাখাল পাড়ি দেওয়ার মজাই আলাদা। তবে সতর্ক থাকতে হবে। আপনি চাইলে আগেভাগে বুকিং দিয়ে রাত কাটাতে পারবেন লালাখালের পাশে সদ্য গড়ে ওঠা একমাত্র রিসোর্টে। রিসোর্টের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাও আছে।

কিভাবে যাবেন ও সৌন্দর্য উপভোগ করবেনঃ


সিলেট থেকে সড়কপথে সিলেট-তামাবিল সড়কে সারিঘাট এসে তার পর এক থেকে দেড় ঘণ্টার নৌ ভ্রমণ।সারিঘাট থেকে প্রতি ঘণ্টায় নৌকা ছেড়ে যায়। স্থানীয়রা নৌকায় যাতায়াত করেন। খালের যেখানে শুরু, সেখানেই রয়েছে সুন্দর এক চা বাগানসহ ফ্যাক্টরি। বাগানটিও খুব পরিচ্ছন্ন এবং সুন্দর।  ওখানেই চাইলে ঘুরে আসা যাবে আদিবাসীদের পল্লী। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ আপনাকে নিয়ে যাবে অচেনা এক দেশে। একটু এগোলেই ওপারে ভারতের সীমান্ত আপনাকে জানিয়ে দেবে, আর এগোনোর পথ নেই।

লালাখালের দুই পাড়ে তেমন কোনো বাড়িঘর নেই; কিন্তু আছে হরেক রকমের গাছপালা। যেন চারপাশে সবুজের হাতছানি। মাঝেমধ্যে কাশবনের ঝোপ চোখে পড়ে। তবে নদীতে অসংখ্য বাঁকের দেখা মেলে। প্রতিটি বাঁকই দেখার মতো সুন্দর। নদী থেকে দূরে পাহাড় দেখা যায়। দেখলে যতটা কাছে মনে হয়, আসলে তত কাছে না। পাহাড়গুলোকে দেখলে মনে হয়, কেউ যেন নিজ হাতে থরেথরে একের পর একটি করে সাজিয়ে রেখেছে। এখানে পাহাড়ের গায়ে মেঘ জমা হয়। একটু কাছ থেকে দেখা যায়, মেঘেরা দল বেঁধে পাহাড়ের গায়ে ঠেস লাগিয়ে থেমে থাকে। আবার কখনো দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে যায়। কখনো মেঘ বেশি জমা হলে এখানে বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। নদী আর পাহাড় মেলবন্ধনে নদীর টলটলে স্রোতস্বিনী জল আর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণাধারা, এ যেন প্রকৃতির এক মায়াময়ী রূপের বাহানা। নদীর জলে নৌকার ওপর বসে পাহাড় দেখার সৌর্ন্দযই আলাদা। দল বেঁধে এখানে এলে সুবিধা বেশি, কারণ নৌকা ভাড়াটা কমে যায়। ভ্রমণে আনন্দও উপভোগ করা যায় এবং সবাই মিলে হৈচৈ করে আনন্দ ভাগাভাগি করা যায়।

জায়গাটার নামের সঙ্গে ‘খাল’ শব্দ যুক্ত হলেও এটা মূলত একটা নদীরই অংশ। নদীর নাম সারি। পানি স্থির নয়, সব সময় চলমান। কেননা, চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে বেয়ে আসা পানি গড়িয়ে চলেছে লালাখাল দিয়ে। নদীতে স্রোত থাকায় যাওয়ার পথে সময় বেশি লাগে, তেমনি ফিরতি পথে পাওয়া যায় বাড়তি সুবিধা।

এ নদীর পানি নীল, কিন্তু নাম কেন লালাখাল হলো? এমন প্রশ্ন অনেকের। লালাখালকে কেন লালাখাল বলা হয়, তা জানা যায়নি। স্থানীয়দের কাছ থেকেও এর কোনো ব্যাখ্যা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নদীর পানি নীল কেন, বলা মুশকিল। প্রকৃতিতেই এ নদীর পানি নীল। তাই নদীর পানি নিয়ে যে কারো মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। হতে পারত নীলাখাল। মিসরের নীল নদ দেখা সবার ভাগ্যে নাও জুটতে পারে। তবে দেশের এ খাল দেখে নীল জলারাশি দেখার আক্ষেপ মিটতে পারে। কেউ বা আবার নীল নদ দেখতে উদগ্রীবও হতে পারেন। ভ্রমণ শেষে আপনার মনে হতে পারে, এটা সিলেটের নীল নদ বা বাংলার নীল নদ।

থাকার জায়গাঃ


এতক্ষণে আপনার মন চাইছে ঘুরতে আসতে লালাখাল। সঙ্গে যদি অনুসঙ্গ যোগ হয়? আপনি চাইলে পারবেন লালাখালের পাড়ে রাত কাটাতে। আগে সুবিধাটা ছিল না। এখনো যে খুব বেশি, তা বলা যাবে না। একটা মাত্র রিসোর্ট। আগে থেকে বুকিং দিয়েই আসতে হয়। না হলে জায়গা পাওয়া কষ্ট। নর্দার্ন রিসোর্ট নামে রিসোর্টটির নিজেদের পরিবহন ব্যবস্থাও আছে। এ ছাড়া সিলেট শহরে রাত যাপন করে একদিনে মাত্র লালাখাল ঘুরতে পারেন। অথবা বিছনাকান্দি ও জাফলং যেকোনো একটার সঙ্গে মিলিয়ে বিকেলের ভ্রমণটা লালাখালে হতে পারে। সিলেট শহর থেকে বেশ দূর হওয়ায় সন্ধ্যার দিকে নদীতে কোনো নৌকা থাকে না। তাই ভ্রমণ বা ঘোরাঘুরি সন্ধ্যার মধ্যেই শেষ করতে হয়। সবচেয়ে ভালো হয় নৌকা ভাড়া নিয়ে যাতায়াত করলে।

যেতে চাইলে যে পথ ধরবেনঃ


লালাখালে যেতে হলে সিলেটের শিশু পার্কের সামনে থেকে লেগুনা অথবা জাফলংয়ের বাসে চেপে সিলেট-তামাবিল সড়ক ধরে যেতে হবে সারিঘাট। সিলেট আর জাফলং মাঝামাঝি এ স্থানটির নাম সারিঘাট। আগেই বলা হয়েছে, যাওয়ার জন্য পথ দুটি সড়কপথ ও নৌপথ। সড়ক পথে যেতে চাইলে মাইক্রোবাস বা কার ভাড়া নিলে ভালো হয়। তা ছাড়া সিলেট শহর থেকে বাস, লেগুনায় সারিঘাট গিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া নিতে পারেন। নৌপথে যেতে চাইলে আগে সারিঘাট পর্যন্ত একই নিয়মে বাস, লেগুনায় গিয়ে নৌযান ভাড়া নিতে হবে। ফেরার পথে এখান থেকে বাসে কিংবা লেগুনায় আসতে পারবেন। রাত ৮টা নাগাদ যানবাহন পাওয়া যাবে।


খরচাপাতিঃ


সড়কপথে যেতে বেশি লোক হলে মাইক্রো ভাড়া নিলে ভালো। খরচটা কম হবে। সিলেট শহর থেকে শুধু লালাখালের জন্য মাইক্রোর ভাড়া দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে হবে, কার নিলে ভাড়া এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। সারা দিনের প্ল্যান হলে ভোরে সিলেট থেকে রওনা দিতে হবে। তা ছাড়া বাস কিংবা লেগুনায় ৪০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে সারিঘাট যেতে পারবেন। সেখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া ৮০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা আর স্পিডবোটে যেতে চাইলে ভাড়া এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা কম হতে পারে। নৌযানে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে, ভাড়া একই।

সাবধানতা!ঃ


যেকোনো ভ্রমণে নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ উপভোগের জন্য প্রয়োজন দুর্ঘটনা এড়ানো। অদ্ভুত নীল পানি আর ঘন জঙ্গলে বেষ্টিত লালাখালে গেলে তাই চাই বাড়তি সতর্কতা। পানিতে নামার সময় খেয়াল রাখবেন, পানির গভীরতা কতটুকু? প্রয়োজনে গাইড কিংবা সঙ্গে যাওয়া কারো সঙ্গে পরামর্শ করা যেতে পারে। আর ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা! সন্ধ্যার আগে-পরে তাদের পানিতে না নামাই ভালো। স্থানীদের মুখে প্রচলিত আছে, অনেক শিশুকেই নাকি বাকপ্রতিবন্ধী হতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে নানা অসুখও হয়ে থাকে সতর্কতা অবলম্বন না করার ফলে। নদীপথে সন্ধ্যায় নির্জন এলাকা পাড়ি দেওয়াটা সব সময় নিরাপদ নাও হতে পারে। এ জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
ভ্রমণবিলাসী পর্যটকদের জন্য এই স্থান আরো আকর্ষণীয় হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত একটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারি-বেসরকারি তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

লালাখালের নতুন নতুন ছবি দেখতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিন। 

আরো পড়ুনঃ


শিখদের একটি ধর্মীয় স্থান গুরুদুয়ারা নানকশাহী (Gurdwara Nanqshahi is a religious place of Sikhs)

No comments:

Post a Comment